চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পাহাড়ের ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষার প্রত্যয় শুভাশীষ চাকমার

0

প্রদীপ চৌধুরী:
শুভাশীষ চাকমা, এখন চল্লিশোর্ধ্ব তরুণ। জীবিকা কৃষি জমিদারী হলেও সেই ছাত্রজীবন থেকেই মনে গেঁথে আছে জাতিগত সংঘাত, উদ্বাস’ ফেরারি জীবনের ক্ষত আর ঘরপোড়া সময়ের Onno Mediaদুঃখ জাগানিয়া মুহূর্তগুলো। শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের উত্তরাধিকারী হলেও তথাকথিত আভিজাত্যকে পেছনে ফেলে জীবনের সাধ্য ও শ্রম দিয়ে নির্মাণ করে চলেছেন নিরন্তর ছবি আর স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জগৎ।
Shuvashis Chakmaপাহাড়ের সংগ্রামী নারী কল্পনা চাকমার পোট্রেট, নব্বইয়ের দশকে বিদ্যুতের দাবিতে প্রাণহারা নীতিশ চাকমার ছবি, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত দুর্গম জনপদের জন-জীবনের শ্রমচিত্র, জাতিগত সংঘাত ও ঘরপোড়ার দৃশ্যসহ অসংখ্য সাহসী ছবি তিনি তুলেছেন।

বিখ্যাত ‘দৃক’ গ্যালারি এবং ‘ছবিমেলা’-তে তাঁর ছবি স্থান পেয়েছে।
তিনি মনে করেন, যেকোন জাতি-গোষ্ঠীর শিক্ষা-সংস্কৃতি-ভাষা-কৃষ্টি-ঐতিহ্য’র সুরক্ষা ও বিকাশে সৃজনশীলতার কোন বিকল্প নেই। আর বংশ পরম্পরায় পরিপূর্ণভাবে তা বয়ে নিয়ে যেতে পারে একমাত্র চলচ্চিত্রই।
শুভাশীষ চাকমা নব্বইয়ের দশক থেকেই ফটোগ্রাফিতে মনোযোগী হন। ১৯৮৯ সালে ৪ মে রাঙামাটির লংগদুতে একটি জাতিগত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠে তরুণ ও ছাত্র সমাজ। ১৯৮৯ সালের ২০ মে রাঙামাটি থেকে তাঁরা দলবদ্ধভাবে ঢাকায় যাত্রা করেন। ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের মৌন মিছিলটিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন মাইলফলক হিসেবে দেখা হয়। সেই ক্ষোভ আর বেদনা তার মনকে শাণিত করলেও হাত তখনো পরিপক্ক হয়ে উঠেনি। ১৯৯৩-৯৪ সালে মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে পড়ার সময় ফটোগ্রাফির ঝোঁকটা ভালো করেই পেয়ে বসে।
ফটোগ্রাফির পাশাপাশি ১৯৯৪ সালে ‘চলচ্চিত্রম ফিল্ম সোসাইটি’র সাথে যুক্ত হয়ে সাহচার্য লাভ করেন খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলামের। মূলত তাঁর সাথে সহকর্মী হিসেবে যুক্ত হয়েই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সৃষ্টির নেশায় পেয়ে বসে শুভাশীষ চাকমাকে। তারপর ডকুমেন্টারি তৈরিতে হাত দেন।
এর মধ্যে বান্দরবান জেলায় বসবাসরত ‘খুমী’দের তৈরি ‘খুমীস্‌ লাইফ’ এবং খিয়াংদের নিয়ে তৈরি আরো একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বোদ্ধামহলে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে। এই দুটি চলচ্চিত্র প্রচারিত হয়েছে বেসরকারি টেলিভিশন ‘একাত্তর’ এবং ‘এটিএন বাংলা’য়।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতিসত্ত্বার পরিচিতি, সংস্কৃতি’র বিপন্নতার ক্ষেত্রে ভাষাও একটা বড়ো ফ্যাক্টর। খুমীদের সিনেমাটোগ্রাফিতে তাঁদের মাতৃভাষার একটা কঠিন সংবেদনশীল আবহ ঘুরেফিরে উঠে এসেছে।
তাঁর শ্রমসাধ্য এই দুটি ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র সৃষ্টির পেছনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেঘনা গুহ ঠাকুরতা এবং সৃজনশীল বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশ (রিইব)’র অনুপ্রেরণা উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া মূলধারার বিনোদনপূর্ণ চলচ্চিত্রের বিপরীতে অন্ত্যজ শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বের পথটা প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরাম এবং ‘বাংলাদেশ প্রামাণ্য পর্ষদ’।
‘খুমীস্‌ লাইফ’ তৈরির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শুভাশীষ চাকমা বলেন, নব্বই দশকের দিকে ঢাকাতে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে তিনি বেড়াতে যান বান্দরবানের বগালেক এলাকায়। তখনকার স্কুল পড়-য়া লেলুং খুমী ছিলো দলের গাইড।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি জাতিস্বত্তার মধ্যে বিপন্নতম হিসেবে এই জাতি- গোষ্ঠীর প্রতি ভ্রমণকারী দলটির বেশ কৌতুহল ছিলো। আর সরেজমিনে সেই বিপন্নতার অভিজ্ঞতা, নিজস্ব চেতনা এবং পারিবারিক উত্তরাধিকার থেকেই ফিল্ম দুটোতে মনোনিবেশ করেন শুভাশীষ।
আগের চেয়ে তুলনামূলকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্র তৈরি এবং সিরিয়াস ফটোগ্রাফি কমে যাবার প্রবণতাকে তিনি সময়ের বন্ধ্যাত্ব বলেই মনে করেন। কালের প্রয়োজনেই সৃষ্টি অনিবার্য হয়ে উঠে। রাজনৈতিক বাস্তবতা-সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং মননশীল ভোক্তার ঘাটতি যেসব এলাকাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে; পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন তেমনিই এক জনপদ।
এই বক্তব্যের রেশ ধরেই তিনি বলেন, মূল্যবোধের সংকটে পড়ে সবাই এখন প্রেরণাশুন্য।
সৃষ্টির জন্য শ্রম-সাধনাই জরুরি, অর্জন নৈর্ব্যক্তিক। কালের নিক্তিতে বিন্দু পরিমাণ টিকে থাকার মাঝেই শিল্পীর স্বার্থকতা।
শুভাশীষ চাকমা, স্ত্রী ও একমাত্র শিশুকন্যাকে নিয়ে খাগড়াছড়ি জেলাশহরের অদূরে বসবাস করেন।
এখন তিনি পাহাড়ের বিকাশমান কৃষি প্রযুক্তি, দ্রুত পাল্টে যাওয়া কৃষি উৎপাদন ব্যবস’াপনা এবং সেই বাস্তবতায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতিযোগিতাপূর্ণ জীবন সংগ্রাম, অনুন্নয়নের উন্নয়ন, বিপণন বৈষম্যসহ সুক্ষ্মচোখে দেখা যায়না, এমন সব বিষয় নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে চলেছেন। এর মধ্যে বেশক’টি আলোর মুখও দেখেছে।
ভবিষ্যতে তিনি পাহাড়ের মাতৃভাষা সুরক্ষার ক্ষেত্রে চেতনা, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রায়োগিক কৌশল নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরির কথা ভাবছেন। কারণ, খুব দ্রুতই পাহাড়ের অধিকাংশ ভাষা ও সংস্কৃতি বিকৃত থেকে বিলুপ্তের পথে পা বাড়াচ্ছে। আর এই অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশ তার হাজার বছরের জাতি-ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলবে।
এ ক্ষেত্রে তিনি সরকারের বিশেষ সহযোগিতা পেলে ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
—————–
সৌজন্যে: সুপ্রভাত বাংলাদেশ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. AcceptRead More